বিশ্বকাপ এর মূল্য কত?
উপরের প্রশ্নটা ভাবার মতো। ১৯৭০ সালে মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফাইনালে জিতে জুলে রিমে কাপ একেবারে ঘরে নিয়ে যায় ব্রাজিল। ফলে নতুন আরেকটি কাপ তৈরি করতে হয় নিরুপায় ফিফাকে। ১৯৭১ সালে ইতালির ভাস্কর সিলভিও গাজ্জানিগা ডিজাইন করেন বর্তমান শিরোপা। স্বর্ণের দাম, মজুরি সব মিলিয়ে তৈরির সময় কাপটির আর্থিক মূল্য ছিল মোটামুটি ৫০ হাজার ডলার। মূল্যস্ফীতির মতো আর্থিক ও নানা অর্থবহির্ভূত বিষয়াদি সমন্বয়ের পর এখন ট্রফিটির দাম ১০ মিলিয়ন ডলারের কম হবে না। এ পরিমাণ অর্থের বাজারমূল্য বোঝাতে বোধগম্য একটি তুলনা দেয়া যায়। সেটি হলো, ১৮ ক্যারেট স্বর্ণ দিয়ে দুজন প্রমাণ সাইজ ও গড় ওজনের মানুষের ভাস্কর্য গড়া যাবে এখনকার কাপটি বিক্রি করে!
ফাইনালে ২২ জন খেলোয়াড় তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত হবেন শিরোপার জন্য। প্রায় একই মাত্রার ‘হাইভোল্টেজ’ ম্যাচ কিন্তু দেখা গেছে মাঠের বাইরেও, বিশ্বকাপ কোন দেশ আয়োজন করবে— সেটি নির্ধারণ নিয়ে। কেননা সম্মান-অর্থ ছাড়াও এক ব্যাপকতর অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে ফুটবলের এ সর্ববৃহত্ প্রতিযোগিতার। গত তিন বিশ্বকাপের সার্বিক পরোক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাবের ওপর একটা হিসাব আমার কাছে আছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ওই তিনটিই ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলে আয়োজক দেশে। ২০০২ সালে জাপান ও কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপের মোট আর্থিক মূল্য ছিল ৯ বিলিয়ন ডলার। পরের বার (২০০৬ সাল) বিশ্বকাপ খেলা হয়েছে জার্মানিতে। সেটি সৃষ্টি করে আনুমানিক ১২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের দাম ন্যূনতম ৫ বিলিয়ন ডলার বলা যায়। এখন ব্রাজিলে যে টুর্নামেন্ট চলছে, একাধিক অর্থনীতিবিদের মতে তার মূল্য সীমাবদ্ধ থাকবে ৩ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের মাঝে। তদুপরি রয়েছে এর মধ্যমেয়াদি প্রভাব। একাধিক প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা শেষ হওয়ার পর থেকে অর্থাত্ ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে শুধু বিশ্বকাপ উপলক্ষে ৩০ বিলিয়ন ডলার যুক্ত করেছে ব্রাজিলের জিডিপিতে। এসব বছরে বার্ষিক ৩ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন হারে জনগণ যুক্ত হয়েছেন শ্রমবাজারে এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত চলমান (অবশ্যই সংশ্লিষ্ট) বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি থেকে দেশটির সরকার রাজস্ব অর্জন করেছে ৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এখন মাসব্যাপী চলা উত্সবে অতিরিক্ত ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন পর্যটক আসতে পারে বলে ধারণা। তাদের প্রত্যেকে মাথাপিছু ব্যয় করবেন গড়ে ২ হাজার ৪৮৮ ডলার!
কিছু উপজাত প্রভাব রয়েছে বিশ্বকাপের। বেশির ভাগ সময়ই সেগুলো আবার স্বাগতিকদের পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যায়। আন্দাজে বলছি না। গবেষণা হয়েছে এর ওপর। ২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্ট চলাকালে যুক্তরাজ্যে গবেষণা চালানো হয়েছিল। তাতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বকাপ সাময়িক প্রভাব ফেলেছে ৭০ শতাংশ ব্রিটিশ পুরুষ ও ৬২ শতাংশ ব্রিটিশ নারীর কর্মজীবনে। ৬২ শতাংশ পুরুষ ও ৫২ শতাংশ নারী বলেছেন, প্রিয় দলের জয় জীবনযাত্রায় সুপ্রভাব ফেলে। সেসময় বিপুলসংখ্যক মানুষ বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে আয়েশ করে বড় পর্দায় খেলা দেখার জন্য দামি টিভি কিনেছেন। মজার বিষয়, তখন বারবিকিউ যন্ত্রপাতি-উপকরণের দামও বাড়ে; আমুদে দর্শকের উত্সবের সঙ্গী হতে গিয়ে। জার্মান বিশ্বকাপে ব্যাপক পুষ্ট হয় ব্রিটিশ খুচরা খাত। সব মিলিয়ে কমপক্ষে ২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত পানীয়, পিত্জা প্রভৃতি বিক্রি করে তারা।
বিশ্বকাপ হলো বিশ্বফুটবলের পরিচালনা পর্ষদ ফিফার পয়মন্ত আসর। একটা বিষয় খেয়াল করেছেন? আর্থিক বিবরণীতে ফিফা কখনো মুনাফা বলে না; লেখে ‘ইতিবাচক ফল’। ১৯৯৮ থেকে ২০০২-এর টুর্নামেন্ট পর্যন্ত ফিফার জন্য প্রায় ১২৯ মিলিয়ন ডলারের ‘ইতিবাচক ফল’ নিয়ে আসে বিশ্বকাপ। তার পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩৯ মিলিয়ন ডলার। ইতিবাচক ফল মোটামুটি দ্বিগুণ বেড়ে ৭০৫ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে ২০১০ সালের মধ্যে। কোনো কোনো মুখপোড়া একবার উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, ফিফার এভাবে উপার্জন প্রবৃদ্ধি কি নৈতিক ও আইনসঙ্গত? ফিফা বসে থাকার পাত্র নয়। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ১৮৩ মিলিয়ন ডলার এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে সংস্থাটির। তহবিলে আরো ৩৫ মিলিয়ন ডলার রেখে দেয়া হয়েছে এবারের চ্যাম্পিয়ন দলকে দিতে হবে। তবে বিশ্বকাপ এলে ফিফার চেয়ে বেশি খুশি হয় তার আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য অংশীদাররা। ম্যাচ গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এদের হাসিও বিস্তৃত হতে থাকে। হবে না কেন? ২০০৬ সালে জার্মান বিশ্বকাপ চলাকালে অ্যাডিডাস বিক্রি করে ৩ মিলিয়ন জার্সি। ফুটবল শার্ট দ্বিগুণ বিক্রি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা টুর্নামেন্টে। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে ইউটিউবে চ্যানেল খুলেছিল ভিসা। সেখানে দর্শকরা ঢুঁ মারেন আনুমানিক ৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন বার। অথচ ভিসার প্রত্যাশা ছিল এর অর্ধেক। পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝেছেন, কেন বিশ্বকাপের মূল্য তাদের কাছে অত্যন্ত চড়া?
সবখানেই কিছু কিন্তু থাকে। বিশ্বকাপের অর্থনীতিও তা থেকে মুক্ত নয়। অনেকে বিশ্বাস করেন, বিশ্বকাপ আয়োজনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ঘিরে যেসব সুন্দর সুন্দর পরিসংখ্যান দেয়া হয়; তার কয়েকটি সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার অথবা তাদের বিশেষ পরামর্শকের মস্তিষ্কপ্রসূত। জনগণকে সুখবর দেয়ার গোপন বাসনা সব সরকারেরই আছে। কেননা, সুখবরে জনগণ তুষ্ট হয়; অন্তত তাদের রাগ, অসন্তোষ কমে। তাছাড়া অর্থনীতিবিদ ভাড়া করে এনে নিজ কর্মের মুণ্ডুপাত কে করবে? এসব বিষয়ে স্থির মন্তব্য দেয়া কঠিন। বিশ্বকাপের মূল্য বুঝতে গিয়ে এক্ষেত্রে তাই কিছু বিরোধাত্মক চিত্র তুলে ধরাই শ্রেয় মনে করছি। আশাবাদী একদল অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সব দিয়ে-থুয়ে এবারের বিশ্বকাপ থেকে সাকুল্যে ৩ বিলিয়ন ডলারের মুনাফা হবে ব্রাজিলের। কিছু বিশ্লেষক আবার মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখিয়ে বলছেন, আসর আয়োজন করতেই তো ব্রাজিল ব্যয় করে ফেলল ১১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। সত্য যে, নানা কারণে চলতি বিশ্বকাপের প্রাক্কলিত ব্যয় লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়; শুধু স্টেডিয়াম-সংক্রান্ত ব্যয়ই বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বিশ্বকাপ আয়োজনের পরোক্ষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যয়ও আছে বৈকি। বিশ্বকাপ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে গত বছরের নভেম্বর থেকে প্রতি মাসে গড়ে মারা গেছেন একজন শ্রমিক। এ ধরনের ঘটনা ব্রাজিলের জন্য নতুন নয়। অনেক স্বাগতিক দেশেই এর উদাহরণ রয়েছে। শেষ গ্রীষ্মে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে ফেডারেশন কাপ চলাকালে ব্রাজিলজুড়ে বড় আকারে এবং ঘন ঘন প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা যায়। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, ফিফাকে কেন বিশেষ কর ছাড় দেয়া হলো, বাস ভাড়া কেন বাড়ল প্রভৃতি ইস্যুতে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে বেশ। এ সময়ে বাজেটে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি সচেতনদের চোখ এড়ায়নি স্বভাবতই। আসর শুরু হয়ে যাওয়ায় মানুষজন আপাতত চুপ মেরে আছে। টুর্নামেন্ট শেষে তাদের ফুঁসে ওঠা বিচিত্র হবে না মোটেই। বস্তি উচ্ছেদ কর্মসূচির মতো উদ্যোগে আবার সরকারি ব্যয় বেড়েছে। এসব বস্তিতে প্রচুর মাদক ব্যবসায়ী ছিল। ফলে বস্তি তুলে দেয়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে নিরাপত্তা ব্যয়ও। এদিকে ব্যয় বাড়লেও অপরাধ সংঘটনের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে, সে কথা বলা যাবে না। গত বছর জানুয়ারিতে রিও ডি জেনিরোয় ১৯৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সংখ্যাটি তিন গুণের বেশি ছিল। কিংবদন্তি ফুটবলার রোমারিও এখন ব্রাজিলের রাজনীতিক। তিনি দেশটির বর্তমান সরকার গৃহীত নানা পদক্ষেপের কট্টর সমালোচক। তার মতে, এ ধরনের ব্যয়বহুল টুর্নামেন্ট কার্যত ব্রাজিলের অর্থনীতিকে খোঁড়া করে দিয়েছে। তার মতো আরো অনেক ব্রাজিলিয়ানই বিশ্বাস করেন, হুজুগই সব; আদতে বিশ্বকাপ অতটা মূল্যবান নয়!
স্বাগতিক দেশে বিক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অপরাধ বৃদ্ধি প্রভৃতি সামাজিক দুশ্চিন্তা। এক্ষেত্রে আছে অর্থনৈতিক ভাবনা কম কীসে! বৈশ্বিক ক্রীড়া আসর আয়োজনের একটা কালো দিক বলতে হয়, স্বাগতিক দেশে ক্রীড়া পর্যটক বাড়লেও এ ধরনের মেগা ইভেন্ট চলাকালে স্বাভাবিক সময়ের পর্যটকদের আনাগোনা কমে যায়। এদিক থেকে বিশ্বকাপ জিরো-সাম গেম বলা যেতেই পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের কথা ধরুন। ২০১০ সালে দেশটিতে ৩ লাখ ৯ হাজার পর্যটক এসেছেন টুর্নামেন্ট চলার মাসে। অথচ বছরের বাকি সময়টায় সেখানে গড়ে প্রতি মাসে এসেছে ৬ লাখ ২০ হাজার পর্যটক। চলতি বিশ্বকাপের আরেকটি বড় নেতিবাচক দিক রয়েছে। তা খেলার সময় নির্ধারণ-সংক্রান্ত। ইউরোপবাসীকে ব্রাজিল বিশ্বকাপের অনেক খেলা দেখতে ছুটতে হবে তড়িঘড়ি করে বাড়ি গিয়ে। উত্তর আমেরিকার মানুষ খেলা পাবেন ভরদুপুরে; কাজের সময়টায়। বিশ্বকাপ ফুটবলের বিপুল দর্শক রয়েছেন এশিয়ায়। খেলা দেখতে তাদের অনেককে জেগে থাকতে হবে মাঝরাত পর্যন্ত। ফুটবল খেলা অবশ্যই উপভোগ্য। কিন্তু খেলা দেখতে গিয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে কর্মীরা অফিস করছেন, এ দৃশ্য কোনো বস দেখতে চান? অন্যত্র গবেষণা হয়েছে কিনা জানি না। তবে আমাদের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ফিফা ২০১৪ বিশ্বকাপের প্রভাবে ৪ বিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির।
এবার আপনারাই বলুন, বিশ্বকাপের মূল্য কত? এককথায় এর উত্তর দেয়া আসলেই কঠিন। তার জবাব অনেকটাই নির্ভর করে উত্তরদাতার মেজাজ-মর্জি ও চিন্তা-চেতনার ওপর। যিনি গোল্ডেন বুট বা বল জিতবেন তার কাছে এবারের বিশ্বকাপ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিজয়ী দলের সদস্যদের কাছেও এর স্মৃতি হবে অত্যন্ত প্রিয়। আর ফিফার কাছে এমনিতেই বিশ্বকাপ কাঁচা টাকা; স্পন্সরদের কাছে চাহিদা-সরবরাহের মহোত্সব। এর মাঝে রিওর যে বস্তিবাসীরা বিশ্বকাপ আয়োজনকে অর্থের অপচয় বলে, তাদের মন্তব্যে কী এসে যায়?
লেখক: স্পোর্টস বিজনেস স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড মার্কেটিংয়ের অধ্যাপক, কভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটি ফিসক্যাল টাইমস থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তর জায়েদ ইবনে আবুল ফজল
No comments