এক নজরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
১| প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরর পূর্বে অস্টিয়ার যুবরাজকে কোন শহরে হত্যা করা হয়েছিল?
উত্তরঃসারায়েভো।
২| প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়?
উত্তরঃ১৯১৮সালের ,১১ নভেম্বর।
৩| প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে জার্মানি আমেরিকার কোন জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়?
উত্তরঃ লুসিতানিয়া।
৪| ভার্সায় চুক্তি কবে সাধিত হয়?
উত্তরঃ ২৮ ই জুন,১৯১৮ সালে।
৫| প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় রাশিয়ার প্রিসিডেন্ট কে ছিলেন?
উত্তরঃজার নিকোলাস(২য়)।
৬| কাকে হত্যা করায় ২য় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমির সৃষ্টি জয়?
উত্তরঃ প্রিন্স ফার্ডিন্যান্ড।
৭| প্রিন্স বিসমার্ক কোন দেশের প্রধানসন্ত্রী ছিলেন?
উত্তরঃ জার্মানি।
৮| জার্মান বাহিনী কবে ব্রাসেলস্ দখল করে নেয়?
উত্তরঃ ২০ আগষ্ট,১৯১৪।
১০| কত তারিখে জাপান 'জার্মানির' বিরুদ্বে যুদ্ধ ঘষনা করে?
উত্তরঃ ২৩ আগষ্ট,১৯১৪।
১১| কবে ইতালি নিরপেক্ষ নীতি ত্যাগ করে মিত্রপক্ষ যোগ দেয়?
উত্তরঃ ১৯১৫ সালে।
১২| কবে 'বার্দুন' যুদ্ধে জার্মান বাহিনী মিত্রশক্তির নিকট পরাজিত হয়?
উত্তরঃ ২১ ফেব্রুয়ারি,১৯১৬।
১৩| ১ম বিশ্ব যুদ্ধেরর সময় 'ফান্সের' প্রধান মন্ত্রি কে ছিলেন?
উত্তরঃ ক্লিমেন শো।
১৪| অক্ষ শক্তি ছিল কোন দেশগুলো?
উত্তরঃ জার্মানি,অষ্ট্রিয়া,তুরস্ক।
১৫| যুক্তরাষ্ট্র কবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে?
উত্তরঃ ৬ই এপ্রিল,১৯১৭ সালে।
১৬| মিত্রশক্তির সাথে জার্মানির 'আর্মিনিস্টিস সন্ধি' নামক যুদ্ধ বিরতি চুক্তি কবে সম্পন্ন হয়?
উত্তরঃ ১১ই নভেম্বর,১৯১৮ সালে।
১৭| রাশিয়া-জার্মান যুদ্ধেবিরতি চুক্ত অনুযায়ি কোন দেশ সমূহ জার্মানির হস্তগত হয়?
উত্তরঃ 'বাল্টিক' রাষ্টসমূহ।
১৮| আধুনিক তুরস্কের জনক কে?
উত্তরঃ আনোয়ার পাশা।
১৯| প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে ছিলেন?
উত্তরঃ উড্রো উইলসন।
২০| প্রথম মহাযুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ছিল?
উত্তরঃ ১৯১৪-১৯১৮ সাল পর্যন্ত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঃ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে বলা হয় সভ্যযুগের সর্বপ্রথম অসভ্য যুদ্ধ। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম এ যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় চার বছর। এটি ইউরোপিয়ান মহাযুদ্ধ নামেও পরিচিত ছিল। পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই যুদ্ধে প্রায় সবাই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ যুদ্ধের কারনে প্রাণ হারান প্রায় দেড় কোটি মানুষ। শুধু তাই নয়, আহত হন দুই কোটিরও বেশি মানুষ। এই যুদ্ধে তিনটি সাম্রাজ্যের পতন হয়। সেই সাথে বিশ্ব মানচিত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন আসে।
প্রথম যুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই এবং শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। এই যুদ্ধ মূলত শুরু হয় অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় আর সার্ভিয়ার মধ্যে। পরে দুই দেশের পক্ষ হয়ে নানা দেশ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এই যুদ্ধের কারণ হিসেবে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য বসনিয়া-হার্জেগোভিনা দখল করা এবং আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকাণ্ডকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে কেন বিভিন্ন দেশ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে তা বুঝতে হলে আপনাকে নিচের অংশটুকু পড়তেই হবে।
ফ্রান্সের ঐতিহাসিক শত্রুতার কারণে ব্রিটেন প্রথমদিকে জার্মানির প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। কিন্তু জার্মানি ব্রিটেনের সঙ্গে নৌ-প্রযুক্তিতে পাল্লা দিতে শুরু করায় সম্পর্কটি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে। ফ্র্যাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পর থেকে জার্মান ও ফরাসিদের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।
অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্ডিনান্ড ও স্ত্রী সোফিয়া হত্যাকান্ডের মাধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু হলেও যুদ্ধের পটভূমি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ইউরোপে প্রধান পরাশক্তিগুলো ব্যালান্স অফ পাওয়ার রক্ষার্থে ক্রমাগত রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ শুরু করে । একই সাথে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। যার ফলে ১৯ শতকে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে রাজনৈতিক ও সামরিক জোট সৃষ্টি হয়। ১৮১৫ সালের দিকে প্রুশিয়ান, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে হলি এলায়েন্স নামে জোটের শুরু। উনিশ শতকে মধ্য ইউরোপে শক্তিশালী সাম্রাজ্য; অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান এম্পায়ার। এসময় সাম্রাজ্যটি শাসন করত হাবসবার্গ রাজবংশ। ১৮৬৭ সালের এক সমঝোতার পর হাবসবার্গ রাজবংশ হাঙ্গেরি শাসন করতে সম্মত হয়। কাজেই, অস্ট্রো -হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্যটি ছিল একধরনের দ্বৈতরাজতন্ত্র।
১৮৭১ সালে যখন জার্মানি একত্রিত হয়েছিল, তখন প্রুশিয়ানরা নতুন জার্মান জাতির অংশ হয়ে গেল। ১৮৭২ সালে বিসমার্ক বার্লিন এক সম্মেলন আহ্বান করে। এবং জার্মানি, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মাঝে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই সম্মেলনে জার্মানির সম্রাট প্রথম উইলিয়াম, রাশিয়ার জার – প্রথম আলেকজান্ডার এবং অস্ট্রিয়ার সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস উপস্থিত হন। এই তিন সম্রাটের চুক্তি ইতিহাসে আজও ত্রিশক্তির চুক্তি নামে পরিচিত। সে সময়, অর্থাৎ উনিশ শতকে বলকান (গ্রিস ও তুরস্কের উত্তরে) ছিল তুরস্কের অটোমান সুলতানের শাসনাধীন । এর মধ্যে অন্যতম শ্লাভ (জাতি)-অধ্যুষিত বসনিয়া-হার্জেগোভিনা। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্য বসনিয়া-হার্জেগোভিনা দখল করে নিতে উদ্যত হল। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্যের এহেন সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সাকে অটোমানরা সামরিক শক্তি দ্বারা প্রতিরোধ করতে পারেনি। এর কারন হল, অটোমানদের শক্তি এতদিনে ক্ষয়ে আসছিল। ২য় কারণ-অত্র অঞ্চলে শ্লাভ জাতীয়তাবাদের বিকাশ।
আবার ১৮৭৭-১৮৭৮ সালে রুশ-টার্কিস যুদ্ধে হলি এলায়েন্সের কার্যকারিতা বিনষ্ট হয়। এই যুক্তিটি ব্যর্থ হয়, এই চুক্তিটি ব্যর্থ হবার কারন হল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও রাশিয়া বলকান নীতির সাথে একমত হতে পারেনি।এবং রাশিয়া এই ত্রিশক্তির চুক্তি থেকে বেড়িয়ে যায়। ১৮৭৯ সালে জার্মান অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ডুয়েল অ্যালায়েন্স নামে একটি জোট গঠন করে। অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল সাথে সাথে এটি বলকান অঞ্চলে রাশিয়ান প্রভাব মোকাবেলার একটি পদ্ধতি হিসেবে দেখা হয় । ১৮৮২ সালে ইতালি অন্তর্ভুক্ত হবার পরে এই দলটি ত্রিপল জোটে পরিণত হয়। মূলত এই সময় ইউরোপ ছিলো গোপন চুক্তির আতুর ঘর। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। আর এই অবিশ্বাস বয়ে আনে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ!
ফ্রান্স ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে টু-ফ্রন্ট যুদ্ধ এড়াতে প্রচেষ্টায় জার্মানির পক্ষ থেকে বিসমার্ক বিশেষ করে রাশিয়ার পক্ষে কাজ করে। উইলহেলম II যখন জার্মান সম্রাট (কায়সার) হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন বিসমার্ক অবসর গ্রহণের জন্য বাধ্য হন এবং তার জোট ব্যবস্থার ধীরে ধীরে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে । উদাহরণস্বরূপ, ১৮৩২ সালে কাইজার রাশিয়ার সাথে রিইনসুরেন্স চুক্তি পুনরায় নতুন করে নবায়ন করতে প্রত্যাখ্যান করেন। দুই বছর পরে, ট্রিপল অ্যালায়েন্সের বিরোধিতা করার জন্য ফ্র্যাঙ্কো-রাশিয়া জোট বদ্ধ হতে চুক্তি স্বাক্ষর করে । ১৯০৪ সালে, ব্রিটেন এন্টেনট কর্ডিয়ালসহ ফ্রান্সের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ১৯০৭ সালে ব্রিটেন ও রাশিয়ার অ্যাংলো-রাশিয়ান কনভেনশনে স্বাক্ষরিত হয়। যদিও এই চুক্তিতে ফ্রান্স বা রাশিয়ার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সহযোগী হিসেবে ব্রিটেন ছিল না, তারা ফ্রান্স বা রাশিয়ার সাথে ভবিষ্যতের কোনও দ্বন্দ্বের মধ্যে ব্রিটেনে প্রবেশ ঘটায় এবং এই দ্বিপাক্ষিক দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ব্যবস্থাটি ট্রিপল এন্টেন্ট নামে পরিচিত হয়েছিল।
১৮৭১ সালে জার্মানী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদের যুগে ১৮৯৮ সালে এসেই তাদের উচ্চাকাঙ্খী সম্রাট, কাইজার দ্বিতীয় উইলহেইমের মনে ইউরোপের বাইরেও সাম্রাজ্য স্থাপনের ইচ্ছা জাগে। অবশ্য জার্মান অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তি শক্তিশালী থাকায় জার্মানরা সেই স্বপ্ন দেখার মত অবস্থানে ছিলও।
অন্য দিকে রাশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসও ক্ষয়িষ্ণু অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয়ান সাম্রাজ্যের এলাকায় নিজ প্রভাব বিস্তারের দিকে নজর দেয় এবং ঘরোয়া সমস্যা মানে লেনিনের নেতৃত্বে তৎকালীন কম্যুনিস্ট বিপ্লব থেকে জনগণের নজর ফেরানোর জন্য এবং ক্ষমতা নিশ্চিতের জন্য এটিকে ইতিবাচক মনে করে। এছাড়াও অস্ট্রিয়ার সুত্র ধরে সার্বিয়ায় জার্মান উপস্থিতি রাশিয়া একটি নিশ্চিত হুমকি স্বরূপ দেখে!
ভৌগলিকভাবে ব্রিটেন ইউরোপের বাইরে অবস্থিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র । ব্রিটেন সেসময় প্রচন্ড শক্তিশালী নৌ-শক্তির অধিকারী একটি সাম্রাজ্য। ব্রিটেন নৌ- সামরিক শক্তি দ্বারা তৎকালীন সময়ের অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথে একক আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল । এছাড়াও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তার কলোনিগুলোর সাহায্যে তৎকালীন বিশ্বে ব্রিটেন ছিল একক পরাশক্তি। জার্মান উত্থান ছিল তার চোখে নিজ শক্তির প্রতি হুমকি! এবং জার্মান দৃষ্টি ছিল ব্রিটেনকে চ্যালেঞ্জ করা!
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী ও অটোমান সাম্রাজ্য ২টি অতীতে প্রচন্ড শক্তিশালী কিন্তু সেইসময় পতনের মুখে থাকা শক্তি, জার্মানীর সাহায্যে তাদের হারানো ক্ষমতা ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখে ।
ফ্রান্স তখন, আফ্রিকার কলোনী থেকে প্রাপ্ত সম্পদের কারনে বেশ ভাল অবস্থানে থাকলেও একটি শক্তিশালী জার্মানী মানেই তাদের ভয়াবহ ক্ষতির কারন। এভাবে তারা দীর্ঘ সময় ধরে পরস্পরকের তারা রেশারেশির দিকে ঠেলে দেয়।
এদিকে, ১৯০৯ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্য এবার বসনিয়া-হার্জেগোভিনা দখলই করে বসে। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্যের এরুপ বেপরোয়া আগ্রাসনের ফলে অত্র অঞ্চলে সৃষ্টি হল বসনিয় সঙ্কটের । বলকানে ক্ষমতা খর্ব হবে বলে রাশিয়া অনেক আগে থেকেই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্যের ওপর হয়ে উঠেছিল ক্রোধান্বিত।
বসনিয়ার অনেক জাতীয়তাবাদী তরুণই এই ব্যাপারটা নিয়ে ক্ষিপ্ত যে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য তাদের দেশকে দখল করে নিয়েছে। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ানরা সেখানে ছিল ১৮৭৮ সাল থেকে। এই সময়টুকুর মধ্যে তারা পুরনো ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটায় নি। কৃষকরা তখনো সামন্তবাদী ভূস্বামীদের দাসের মতো। এটা ছিল একটা পুরনো ঔপনিবেশিক শোষণের পরিস্থিতি। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ানদের আগ্রহ ছিল একটা জিনিসের প্রতিই। সেটা হল কাঠ। বসনিয়ার উপত্যকাগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে কাঠ পাওয়া যায়। সেই কাঠ তারা নিয়ে যেতো – কিন্তু তার বিনিময়ে স্থানীয় অধিবাসীরা কিছুই পেতো না।
এই সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বসনিয়ান তরুণদের একটি অংশ ঠিক করলো, তারা নিজেরাই এর বিরুদ্ধে কিছু একটা করবে। তবে তীব্র প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল বসনিয়রার মুক্তিকামী জনতা। স্বাধীকারের লক্ষ্যেই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ‘নিপাত যাক’, ‘নিপাত যাক’ বলে বসনিয়ায় অনেক কটা উগ্রপন্থি জাতীয়তাবাদী দল তৈরি হয়ে যায়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ইয়ং বসনিয়া’ বা সার্ব ভাষায়: মালদা বসনা। এরই একজন একনিষ্ট সদস্যে ছিল গাভরিলো প্রিন্সেপ নামে ১৯ বছর বয়েসী একজন বসনিয়-সার্ব ছাত্র। যার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। এ বিষয়ে আমরা পরে আলোকপাত করব।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে আরো একটি বিষয় উঠে আসে সেটি হল অর্থনীতিক আগ্রাসন, International Political Economy, Marxism এর মতে সব কিছুই অর্থনীতির সাথে যুক্ত এবং বিশ্বের সকল ইতিহাস হলো অর্থনৈতিক ইতিহাস (Class Discrimination – শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস)। প্রথম মহাযুদ্ধের পুর্বে ইউরোপের অন্যান্য দেশ, আফ্রিকা, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকাতে নিজ নিজ কলোনি স্থাপন করে । ব্রিটিশ এবং ফ্রান্স অর্থনৈতিক ভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও জার্মান দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছিলো। সেই সময় জার্মান পণ্য ব্রিটিশ পণ্যের বাধার সম্মুখীন হয়। আগের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পাশে আরেকটি নতুন শক্তি জার্মানির আগমন ঘটে। যার ফল হিসেবে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক দ্বন্দের সূচনা করে ধীরে ধীরে সংঘাতের দিকে ধাবিত হয়। একটা বিষয় সব সময় মনে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে , আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোন শত্রু-মিত্র নেই বরং আন্তর্জাতিক রাজনীতি’র মূলনীতি হচ্ছে ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগীতা এবং “ব্যালেন্স অব পাওয়ার”! মানে, কোন রাষ্ট্রই চায় না অন্য একটা রাষ্ট্র এতটা শক্তিশালী হোক যা আগামীতে নিজেদের জন্য হুমকি হতে পারে। এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভুমি হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ন আরেকটা মনে রাখার বিষয় হলো, জার্মানী-অস্ট্রিয়া এবং ইটালীর মাঝে ১৮৮২ সাল থেকে সামরিক জোট গঠনের চুক্তি বলবৎ ছিল, ১৯০২ এ সেটা নবায়ন হয়। এবং এটার “কাউন্টার ওয়েট” হিসেবে ১৯০৪ সালে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স যৌথ সামরিক চুক্তি ।
শুরু হয় যুদ্ধের দামাদামা
বিশ্ব রাজনীতির লেজে গোবরে অবস্থায়, ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড যিনি ছিলেন অস্ট্রো -হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যে আর্কডিউক বা হাবসবার্গ রাজবংশের একজন সম্মানীয় সদস্য এবং তিনি ছিলেন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান এম্পায়ারের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী তিনি ১৯১৪ সালের জুন মাসে সস্ত্রীক বসনিয়া-হার্জেগোভিনার রাজধানী সারাজেভোতে ভ্রমণে আসেন। এ সময় গড়ে উঠা উগ্র জাতীয়তাবাদি দল ইয়ং বসনিয়া এর সদস্য গাভরিলো প্রিন্সেপ তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় ।
জুনের ২৮ তারিখ ফার্ডিনান্ড তার স্ত্রীসহ বসনিয়ার রাজধানী সারাজেভোতে গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন। ইয়ং বসনিয়া বা মালদা বসনার নিয়োগ পাওয়া ছয়জন গুপ্তঘাতক (পপভিক, গাভরিলো প্রিন্সেপ, মেহমেদবসিক, নেডেলস্কো কাবরিনোভিক, ট্রিফকো গারভেজ ও ভাস্কো কুব্রিলোভিক ) সারাজেভোতে আর্কডিউকের মোটর শোভাযাত্রার পথে জড়ো হয়। কাবরিনোভিক একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে। কিন্ত গ্রেনেডটি সঠিক স্থানে নিক্ষিপ্ত হয় । গ্রেনেডটি ফার্ডিনান্ডের গাড়ির কাছাকাছি ব্লাস্ট হয়। ফার্ডিনান্ড এ সময় কিছুটা আহত হন। এ সময় গাড়ি বহর চালিয়ে গেলে ঘাতকেরা ব্যর্থ হয়।
এক ঘন্টা পরে সারাজেভোরের হাসতাপাতাল থেকে আহত ফার্ডিনান্ড ফিরছিল। কোন একটা সময় গাড়িটি ভুল টার্ন নেয়। ফলে গাড়িটি ব্যাক করছিল। এ সময় সেখানে গাভরিলো প্রিন্সেপ ফুটপাতের ওপর ক্যাফেতে বসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছিল। হঠাৎই তাঁর চোখ কালো রঙের একটি কনভাট্রিবল গাড়িতে আটকে যায়। গাড়িতে আর্কডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ বসে; পাশে আর্কডিউক-এর স্ত্রী সোফি। কাল বিলম্ব না করে প্রিন্সেপ উঠে দাঁড়িয়ে পিস্তল বের করে মাত্র ৫ ফুট দূর থেকে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি করে। গুলি আর্কডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনাান্দের গলা ফুটো করে বেরিয়ে যায় …এবং সোফির পেট ভেদ করে। কজন পুলিশ গাভরিলো প্রিন্সেপকে জাপটে ধরে।
আর্কডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী সোফি-দুজনই বেলা ১১টায় মারা যায়। ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রানজ ফার্ডিনান্ডকে হত্যাই মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। এই হত্যাকান্ডকে দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হত্যা অথবা সবচেয়ে ভুল হত্যাকান্ড বললে ভুল হবে না!
অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য সার্বিয়াকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানায়। এই হত্যাকান্ড অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিয়া, সার্বিয়া, জার্মান, ফ্রান্স ও রাশিয়াকে একটি কুটনীতিক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় যা জুলাই ক্রাইসিস নামে পরিচিত। সার্বিয়া একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কিন্তু অস্ট্রিয়া একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয় প্রতিবেদন পেশ করার জন্য এবং বিচারের ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্রহণযোগ্য ১০ টি শর্ত বেঁধে দিয়ে তদন্ত কমিটিতে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয়ান সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি নিয়োগের দাবী জানায়। কিন্তু সার্বিয়া এর সব শর্ত মানতে অস্বীকার করে। মূলত সার্বরা বাকি সবগুলো শর্ত মেনে নিলেও ছয় নাম্বার শর্তটি মেনে নেয় নি যেখানে ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয়ান সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিকে তদন্তকাজে অনুমতি দেওয়া। এ অবস্থায় অস্ট্রিয়া কুটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
অস্ট্রিয়ার দ্বারা সার্বিয়া আক্রমনের পরপর ভিন্ন ভিন্ন চুক্তি অনুসারে জার্মানী-অস্ট্রিয়ার সাথে ফ্রান্স- রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অন্য একটি জার্মান-অটোমান চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া যুদ্ধে যোগ দিলে অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানীর পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়ার কথা ছিল, তাই অটোমান সাম্রাজ্যও যুদ্ধে যোগ দেয়!
২৯ জুলাই রাশিয়া সার্বিয়ার পক্ষে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এর বিরুদ্ধে আংশিক সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। ৩০ জুলাই পুরুপুরি সার্বিয়ার পক্ষে মুভ করে। এই অবস্থায় জার্মান চ্যান্সেলর ৩১ জুলাই পর্যন্ত অপেক্ষা করে একে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ বিপদ নামে অভিহিত করে। কাইজার II জার নিকোলাস II কে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে সৈন্য সমাবেশ বন্ধ করতে বলে। যখন রাশিয়া এটি প্রত্যাখ্যান করে তখন জার্মানী রাশিয়াকে সার্বিয়ার পক্ষে সৈন্য সমাবেশ বন্ধ করতে আল্টিমাটাম দেয় এবং সার্বিয়াকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করতে বলে। অন্য একটি আল্টিমাটাম প্রদান করে ফান্সকে যেন রাশিয়াকে সমর্থন না দেয় যেখানে রাশিয়া সার্বিয়ার প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসে। ১ লা আগস্ট জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
জার্মানী নিরপেক্ষ বেলজিয়াম আক্রমন করলে তখন পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন জার্মানীর বিপক্ষে যুদ্ধে ঘোষনা করে! রাশিয়া এবং ফ্রান্স সাথে সাথে যুদ্ধে যোগ দিলেও জার্মানি তাদের ভালই মোকাবেলা করছিল, কিন্তু ব্রিটেনের চোখে রাশিয়া এবং ফ্রান্সের তুলনায় একটি নতুন ও শক্তিশালী জার্মানি ছিল বড় হুমকি তাই তারা পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী ও নিজেদের ক্ষমতার সুরক্ষিত করার জন্যই জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়।
ব্রিটেনের মত পরাশক্তির আগমন জার্মানির জন্য ব্যাপক হুমকি হয়ে দাড়ায়! আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাঝেই রাশিয়া পরাজিত হয়ে যুদ্ধ-ত্যাগ করে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক ( কম্যুনিস্ট) বিপ্লবের ফলে রাশিয়া যুদ্ধ ত্যাগ করে। ব্যাপক সৈন্য ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি ও কম্যুনিস্ট প্রোপাগান্ডাই সম্রাটের পতন ও রাশান পরাজয় নিশ্চিত করে। ইতোমধ্যেই ৩ বছর ধরে চলা যুদ্ধে এবং শীতকালে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতির শিকার জার্মান সেনাবাহিনী অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয় আমেরিকান জাহাজে আক্রমণ করে! কিন্তু ফ্রান্স-ব্রিটেনকে রসদ যোগান দেয়ার অভিযোগে জার্মান সাবমেরিন যখন ৭টি যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ডুবিয়ে দেয় তখন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত যুদ্ধে যোগ দিয়ে এটাকে বিশ্বযুদ্ধ রূপ দেয়! এবং মুলত এরপরই জার্মান পরাজয় নিশ্চিত হয়!
১৯১৪ সালের জুন মাসে এক তরুন সার্বিয়ান কর্তৃক অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্ডিনান্ডকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জার্মান বাহিনীর বেলজিয়াম ও ফ্রান্স দখলের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দখল রথ। তাদের ছিল খুব সহজেই বিজয় পাওয়া যাবে। বছরের পরে বছর ধরে যুদ্ধ চলতে থাকে। এই যুদ্ধ ইউরোপ ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও তাদের মিত্রদের প্রতি সহানূভূতি থাকলে যুক্ত রাষ্ট্র এ সময় নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল।
তবে মিত্রদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক পূর্বের মতই বজায় থাকে। এ সময় ব্রিটিশ নৌবাহিনী সাগরে নিরন্ত্রণ বজায় রাখে। যে কারনে জার্মানীর জন্যে জরুরি পন্য সরবরাহ দুরুহ হয়ে পড়ে। জার্মানরা ইউবোট (ডুবোজাহাজ) দিয়ে মিত্রবাহিনীর নৌ অবরোধ ভাঙ্গার চেষ্টা চালায় । এতে মিত্রপক্ষের অনেক সামরিক, বেসামরিক ও বাণিজ্যিক জাহাজ ডুবে । ১৯১৫ সালে যুক্ত রাষ্ট্রের কিউনার্ড শিপিং কোম্পানির যাত্রিবাহী লুসিটানিয়া জার্মান ইউবোটের টর্পেডোর আঘাতে ঢুবে যায়। নিহত ১১ শ ৯৮ জন যাত্রী। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ১২৮ জন আরোহী ছিল।
ডুবোজাহাজের অত্যাচার আর জিমরমান টেলিগ্রাম ধরা পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে যোগ দেওয় অনিবার্য হয়ে পড়ে। এই টেলিগ্রামের বক্তব্য ছিল মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করলে টেক্সাস, নিউ মেক্সিকো ও আরিজোনা ফিরে পেতে জার্মানি মেক্সিকোকে সাহায্য করবে। আশ্চয্যের ব্যাপার হল যুক্তরাষ্ট্র যখন ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয় তখন তাদের সেনাবাহিনীতে মোট সৈনিক ছিল মাত্র এক লাখ ত্রিশ হাজারের মত ! তখন যুক্তরাষ্ট্রের কোন ট্যাংক ছিল না। যুদ্ধবিমান ছিল হাতে গোনা কয়েকটা।
তখন জার্মানের একজন জেনারেল ব্যাঙ্গ করে বলেছিল “ইউবোট যেভাবে পথে বাধা হয়ে আছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বেশি সৈনিক ইউরোপের মাটিতে পৌঁছাতে পারবে না। এ সময় তড়িঘড়ি করে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদানের আইন জারি করে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় প্রায় ৪০ লাখ নাগরিক। যেখানে ২০ লাখকে ইউরোপে পাঠানো হয়। ২০ লাখ থেকে সরাসরি ১৪ লাখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহনের বিশ্বযুদ্ধ নতুন মোড় নেয়। যুদ্ধের শেষ বছরে জার্মানরা যখন চূড়ান্ত হামলা চালায় তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এত করে ফ্রান্সের মাহনেতে জার্মানদের থামিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, আত্মপ্রকাশ শুরু করল পরাশক্তি হিসেবে। অপর দিকে যুদ্ধের জের ধরে ইউরোপে সাম্রাজ্যের পতন, রাশিয়াসহ জন্ম দিল নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার। ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও শীতল যুদ্ধ। প্যারিস শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ১১ নভেম্বর ১৯১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এ যুদ্ধ সমাপ্ত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলঃ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল সুদূর প্রসারী।
১। যুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে পরাজিত জার্মানিকে ২৬৯ বিলিয়ন ‘গোল্ড মার্ক’ জরিমানা করা হয়, ১৮৭২’র যুদ্ধে জার্মান দখলকৃত ‘আলসাক-লরেন’ এলাকা ফ্রান্স নিয়ে নেয় এবং জার্মানিকে অস্ত্রহীন করে ফেলা হয়। অর্থাৎ ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে কোনঠাসা করে ফেলা হয়, যা হিটলারের মাধ্যমে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়।
২. ১ম বিশ্ব যুদ্ধের পর চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। রোমান সাম্রাজ্য ১৯১৭ সালে, জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ১৯১৮ সালে এবং অটোমান সাম্রাজ্য ১৯২২ সালে। এরমধ্যে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যকে একদম খণ্ড খণ্ড করে ফেলা হয়।
৩. অস্ট্রিয়া, চেক স্লোভাকিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুনিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
৪. অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য বেদখল করা হয় এবং তুরস্কের নানা অংশ দখল করার লক্ষ্যে ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইতালি-গ্রিস তুর্কী ভুখণ্ডে ঢুকে যায় (যদিও কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্ক নিজেদের ভূমি রক্ষা করতে সক্ষম হয়)।
৫. ১৯২২ সালে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্টরা ইতালির ক্ষমতায় আরোহন করে।
৬। প্রায় এক কোটি সৈন্য এবং ২ কোটি ১০ লক্ষ সাধারণ মানুষ আহত হয়, এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল এক লক্ষ ষোল হাজার পাঁচশ ষোল জন।
৭। এ যুদ্ধের অন্য ফল হলো: ইনফ্লুয়েঞ্জায় বিশ্বব্যাপী ২৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়।
৮। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লাভ হলো নারী সমাজের। অতি প্রাচীন কাল থেকে সামাজিক খাঁচায় বন্দি নারী যুদ্ধের সুযোগে বন্ধ ছিন্ন করে আপন শক্তিতে, আপন সত্তায় সচেতন হয়ে পারিবারিক তথা জাতীয় অর্থনীতির হাল ধরল, পুরুষের পাশাপাশি মর্যাদায় উঠে দাঁড়াল। যুদ্ধে সব যুবক এবং সক্ষম পুরুষ চলে যাওয়ায় সর্বত্র শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। নারীসমাজ ঘর থেকে বেরিয়ে খেত, খামারে, কল-কারখানা দোকান, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বক্ষেত্রে দল বেঁধে প্রবেশ করল, চাকরি নিল। ফলে নারীমুক্তি আন্দোলন জোরদার হলো। বিশ্বযুদ্ধের পর আর নারীসমাজকে খাঁচায় পোরা সম্ভব হলো না। মানব ইতিহাসে এক নতুন উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হলো।
আরেকটি বড় ফলাফল হলো- মনরো ডকট্রিন থেকে বের হয়ে এসে যুদ্ধের শেষ দিকে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মুল নায়কের আসনে বসে যায়। যুদ্ধের পর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের নেতৃত্ব শুরু হয় দুনিয়ায় নতুন ধরনের রাজনীতি। আর উইলসন ছিলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গণতন্ত্র ও লিবেরালিজমের প্রবক্তা ও বাস্তবায়নের অন্যতম নায়ক।
যুদ্ধ পরবর্তীকালে বিশ্বনেতারা সবাই এই মর্মে একমত হন যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুদ্ধ একটি অভিশাপ। তাই ভবিষ্যতে সরকারব্যবস্থায় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বচ্ছতার নিশ্চিত করার জন্য গড়ে তোলা হয় ‘লীগ অব নেশন’। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বে পুরো দুনিয়া বদলে দেবার স্বপ্ন দেখিয়ে ইউরোপ থেকে দেশে ফেরার পর মার্কিন সিনেট ভার্সাই চুক্তি অনুমোদন না করায় (ভার্সাই চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল ‘লীগ অব নেশন’ গঠন করা) উইলসনের সমস্ত পরিকল্পনা খারিজ করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে ইউরোপিয়ান ঝামেলা থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, যা নতুন বিশ্বব্যবস্থা সফল করার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববাসী ধারণা করেছিল যে, বিশ্ববাসীকে আর যুদ্ধের অভিশাপ বহন করতে হবে না । কিন্তু লীগ অব নেশনস-এর একটি কার্যকরী বিশ্বসংস্থা হয়ে উঠতে না পারা, ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে কোনঠাসা করে ফেলা এবং জার্মানি ও ইতালিতে যথাক্রমে হিটলার ও মুসোলীনির নেতৃত্বে ফ্যাসিজমের উত্থান আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান তারিখগুলি
যুদ্ধের ৫ বছরের মধ্যে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং অপারেশন ছিল নীচে সংক্ষিপ্ত আকারে সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হল ।
জুলাই ২8 অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং রাশিয়া সার্বিয়া সমর্থনে দাঁড়ায়।
১ আগস্ট, 1914 তারিখে, জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিল ।
১৯১৪ সালের নভেম্বরে, গ্রেট ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে একটি নৌ অবরোধ শুরু করে। ধীরে ধীরে, সকল দেশে সেনাবাহিনীতে জনসংখ্যার সক্রিয় সক্রিয়তা শুরু হয়।
১৯১৫ সালের শুরুতে, জার্মানির পূর্বাঞ্চলে, আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডে বড় আকারের অপারেশন চালু করে । একই বছর এপ্রিলের মধ্যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের শুর করে।
অক্টোবর ১৯১৫ সালে, বুলগেরিয়া সার্বিয়া বিরুদ্ধে সামরিক অপারেশন শুরু করে ।
১৯১৬ সালে, বিশেষত ব্রিটিশরা ট্যাঙ্ক ব্যবহার শুরু করে।
১৯১৭সালে, রাশিয়ার নিকোলাস দ্বিতীয় সিংহাসন থেকে সরে পড়েন, একটি অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় আসে এবং রাশিয়া যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ায়।
১১ নভেম্বর ১৯১৮ সকালে জার্মানির যুদ্ধ বিরতিতে সাক্ষরে করে প্রথম বিশ্বযদ্ধে ইস্তফা দেয়।
১ম বিশ্বযুদ্ধে পক্ষসমূহঃ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তি ও মিত্র শক্তি হিসেবে দুই পক্ষ বিশ্বব্যাপি যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি ছিল ব্রিটেন,ফ্রান্স,সার্বিয়া,বেলজিয়াম ও রাশিয়া।
অন্য দিকে অক্ষ শক্তিতে ছিল জার্মানি,অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি,তুরস্ক।
হতাহতের সংখ্যা ও খরচ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৯০ লক্ষ যোদ্ধা ও ৫০ লক্ষ নিরীহ মানুষ নিহত হয়। এ ছাড়াও প্রায় এক কোটি সৈন্য এবং ২ কোটি ১০ লক্ষ সাধারণ মানুষ আহত হয় এই মহাযুদ্ধে প্রায় ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যক্ষ ও ১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরোক্ষ খরচ হয়। যা ইতিপূর্বে ঘটিত যেকোনো যুদ্ধব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র সমূহঃ
রাইফেল: বল্ট -অ্যাকশন রাইফেল, লেবেল এম ১৮৮৬, মাউজার জিউহর, ওয়েবলি এমকে ফোর, লি এনফিল্ড রাইফেল, স্প্রিংফিল্ড, মানলিচের কারকানো, পিস্তলের মধ্যে ল্যুগার।
মেশিন গান: গার্ডনার মেশিন গান, হচকিস, লুইস গান, ম্যাক্সিম মেশিন গান, মাসচিনেনজিউহর, উইকারস মেশিন গান, ব্রউং মেশিন গান ।
সাঁজোয়া যান: মিলিটারি মোটর বাস, কমার অ্যাম্বুলেন্স,ফোর্ড মডেল টি প্যাট্রল কার, ডেনিস মিলিটারি লরি।
আর্টিলারি: হেভি আর্টিলারি, বিগ বার্থা, গ্রেনেড, হাউটজার, স্কোডা ৩০.৫, মিলস বম্ব
ট্যাঙ্ক: মার্ক ভি, মার্ক ৮ (লিবার্টি), লিটিল উইলি, মার্ক (মাদার) দি হুইপেট, কাররো ফিয়াট টিপো।
অন্যান্য: বেয়োনেট, টর্পেডো, ধোঁওয়াবিহীন গান পাওডার, রাসায়নিক অস্ত্র, ওয়ারলেস কমিউনিকেশন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে প্রাপ্তিঃ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কল্যাণে আমরা বেশ কিছু নতুন জিনিসের সাথে পরিচয় ঘটেছে। এর কিছু জিনিস উপকারী আবার কিছু জিনিস অপকারীর খাতায় ধরা যায়। চলুন তাহলে দেখে আসা যাক এ রকম কিছু আবিষ্কার
স্যানিটারি টাওয়েল বা গামছাঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি হল স্যানিটারী টাওয়েল । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের জন্য যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছিলনা তাই প্রায়শই তাদের নানা সমস্যা পড়তে হত। এ সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে তাই আমেরিকার কিম্বলে-ক্লার্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠান অধিক শোষণ ক্ষমতা সম্পন্ন এই টাওয়েল বা গামছা তৈরি করে। এই টাওয়েলের সরবরাহ পেত আমেরিকান সৈন্যরা ও তার মিত্র বাহিনী। এছাড়াও রেড ক্রসের নার্সরাও এই টাওয়েল ব্যবহার করত।
সেনিটারি ন্যাপকিনঃ ঐতিহ্যগতভাবেই মহিলারা রজঃস্রাব মোকাবেলায়র জন্যে ডিসপোজাবল বা ধোয়া যায় এমন সব জিনিষের তৈরী করেছিলেন। প্রাচীন ইতিহাসে মিশরে নরম প্যাপিরাসের ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায় । তবে আধুনিক স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরী হয়েছিল যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এর সময় এক ধরনের সেলুলোজ ব্যান্ডেজ আবিষ্কৃত হয়। প্রথম দিকে ফরাসি নার্সরাই এই সেলুলুজের ব্যান্ডেজের ব্যবহার শুরু করে। এই সেলুলুজ ব্যান্ডেজ ছিল আগের যে কোন ব্যান্ডেজের চেয়ে পরিষ্কার , স্বাস্থ্যসম্মত ও অধিক শোষন ক্ষমতা সম্পন্ন।
ফরাসীদের দেখাদেখি ব্রিটিশ ও আমেরিকার নার্সরাও এই ব্যান্ডেজ সহসাই ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯২০ সালের দিকে কিম্বারলে-ক্লার্ক নামে একটি আমেরিকান কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান প্রথম বাণিজ্যিক স্যানিটারি ন্যাপকিন বাজারজাত শুরু করে। কটন ও টেক্সারের মিলিত এই স্যানিটারী ন্যাপকিনের নাম ছিল কোটেক্স।
সূর্যের আলো তথা ভিটামিন ডিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সারা বিশ্বে নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। জার্মানিতে প্রায় অর্ধেক শিশু এ সময় রিকেটস রোগে আক্রান্ত হয়। কেউ তখন এ রোগের কোন চিকিৎসা খুঁজে বের করতে পারছিল না। কার্ড হার্লেডেলন্সকি নামে এক জার্মান তখন চারটি বাচ্চার উপর সূর্যের আলো ফেলে পরিক্ষামূলক কাজ চালিয়ে রিকেটস রোগের আরোগ্য লাভের সমাধান খুঁজে পান। রিকেটস রোগ হয় ভিটামিন ডি এর অভাবে আর সূর্যের আলোতে আছে ভিটামিন ডি। এটি আবিষ্কারের পরে সৈনিকরা রিকেটস রোগ থেকে মুক্তির জন্যে রোদ পোহাতে শুরু করেছিল।
হাত ঘড়ি আবিষ্কারঃ যতটুকু জানা যায় হাত ঘড়ি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে। হাত ঘড়ি থাকার ফলে সৈন্যরা সময় জ্ঞান সম্বন্ধে অবগত থাকতে পারবে। ফলে তারা সময়মত তাদের জন্যে নির্ধারিত কাজ করতে সমর্থ হয়। কখন যুদ্ধে যেতে হবে, কখন ঘুমাতে হবে কিংবা খেতে হবে। এ সব কিছু একটা রুটিনের আওতায় চলে আসে।
মোবাইল এক্সরে মেশিনঃ যুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ সৈনিক যন্ত্রণাদ্যক ও জীবন হুমকি আঘাত পায়। সে জন্যে ঐ সময় রোগ নির্ণায়ক এক্স রে মেশিনের খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্ত এক্সরে মেশিনের আকার ছিল খুব বড় যা বহন করা খুব কষ্ট সাধ্য ছিল। এ সময় মেরি কুরি নামক একজন আবিষ্কারক যুদ্ধ শুরুর পরই ফরাসী বাহিনীর জন্যে কয়েকটি মোবাইল বা চলমান এক্সরে মেশিন তৈরির কাজ হাতে নেন। ১৯১৪ সালের অক্টোবরের দিকে তিনি কয়েকটি গাড়িতে এক্স রে মেশিন স্থাপনে সক্ষম হন। যুদ্ধ শেষে এমন ১৮ টি রেডিও লজিক গাড়ি অবশিষ্ট ছিল। পরবর্তীতে আফ্রো-আমেরিকান ফেড্রিক জোনস ১৯১৯ সালে আরো ছোট মোবাইল এক্স রে মেশিনের আবিষ্কার করেন।
জিপার বা চেইনঃ আমরা যে ব্যাগ, প্যান্ট বা কাপড়ে চেইন ব্যবহার করি এটি কিন্ত প্রথম বিস্বযুদ্ধের ফল। যখন ফিতা ব্যবহার করা হয় তখন কাপড়ত খুলতে ও লাগাতে সময় লাগে। এ সমস্যা থেকে মুক্তির জন্যে সৈনিকদের জামা কাপড় দ্রুত খোলা ও পড়ার জন্যে প্রথমে ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় চেইনের প্রচলন শুরু হয়। আর যেহেতু যুদ্ধের সময় বেশি সময় পাওয়া যায় না তাই পোশকে চেন লাগানোর ফলে তা খুলতে সুবিধা হয়।
টিস্যুঃ আমরা সে টয়লেট টিস্যু বা মুখ মোছার জন্য ফেসিয়াল টিস্যু ব্যবহার করি তাও কিন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রাক্কালে ব্যবহার শুরু হয়। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম একটি আবিষ্কার।
এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারঃ বিমান চলাচলের শুরুর দিকে, একবার যখন বিমান মাটি ত্যাগ করত তখন পাইলট এক রকমের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরত । প্রচলিত সংকেত ব্যবস্থা নিশান বা বাতি ছাড়া পৃথিবী থেকে কোন রকমের তথ্য পাওয়া সম্ভব ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এর সময় এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায় ইউএস আর্মি, যখন তারা বিমানে প্রথম রেডিও যোগ করে যা উভয় মুখি যোগাযোগে সক্ষম। সান ডিয়েগোতে ১৯১৫ সালে এটা তৈরী শুরু হয়, ১৯১৬ সালে টেকনিশিয়ানরা ১৪০ মাইল দূরে একটি রেডিও টেলিগ্রাফ পাঠাতে সমর্থ হয়। উড়ন্ত বিমানের সাথেও রেডিও টেলিগ্রাফ বার্তা আদান প্রদান করা হয়। সর্বশেষে, ১৯১৭ সালে ভূমিতে থাকা অপারেটর মানুষের কণ্ঠস্বর রেডিওর মাধ্যমে উড়ন্ত বিমানে সঞ্চালিত করা সম্ভব হয়।
স্টেইনলেস স্টিলঃ হেনরি বেয়ারলি নামে একজন লোক স্টেইনলেস স্টিল এর আবিষ্কার করেন। স্টেইনলেস স্টিল লোহার থেকে এটি বেশ মজবুত, শক্তিশালী ও অপেক্ষাকৃত কম ক্ষয় হয় । ফলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী স্টিলের বন্দুক তৈরি করে যা যুদ্ধকে সহজ করে এবং বুলেটের অপচয় রোধ করে।
কাটা চামচঃ অবাক লাগতে পারে কিন্ত কাটা চামচের ব্যবহার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই শুরু হয়। যুদ্ধের সময় হাত দিয়ে খাবার খেলে আবার হাত ধোয়ার প্রয়োজন পড়ত। আবার তাতেও পানিরও অপচয় ঘটে ও জীবাণু পেটে গেয়ে আক্রান্ত হবারও আশঙ্কা থাকে। এ সকল কারনে কাটা চামচের প্রয়োজন পড়ে।
উপকারী জিনিসের সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা কিছু অপকারী জিনিসও পাই। চলুন দেখে আসা যাক এ রকম কিছু আবিষ্কার।
ট্যাঙ্কঃ ট্যাংক চিনি না এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। আর এ ট্যাংকের ধারনার সৃষ্টি হয়েছিল মধ্যযুগে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা ছবিতে। বিংশ শতকে এসে ব্রিটিশরা গোপনে এই অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালায়। তখন ব্রিটিশরা এর নাম দিয়েছিল ট্যাংক। তবে ফরাসিরাও পাশাপাশি রেনাল্ট আরটি হালকা সাঁজোয়া গাড়ি তৈরী করা শুরু করে। ফরাসিদের গাড়ির উপরে একটি মঞ্চ ছিল যা ঘুরতে পারতো, কিন্ত এ ধরনের কোন মঞ্চ বা এমন কিছু কিছু ব্রিটিশ ট্যাংক নকশায় ছিল না।
ব্রিটিশদরা ১৯১৫ সালে মার্ক ১ নামের ট্যাংকের নকশা করে যা ১৯১৬ সালে প্রথমে যুদ্ধে নামে। আর এর ওজন ছিল প্রায় ১৪ টন। এর সর্বোচ্চ গতি ছিল মাত্র ঘন্টায় ৩ মাইল। দুঃখের বিষয় হল ট্যাংকগুলো যুদ্ধে প্রায়ই ভেঙ্গে পড়ত। যুদ্ধে ভালো উন্নত ট্যাংকগুলো পাঠানো হলেও, এই ভাঙন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যুদ্ধে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা তাদের ট্যাংক নামালে এর প্রতিক্রিয়ায় জার্মানরা একটি সাঁজোয়া যুদ্ধ যান তৈরী করে। যা ছিল এই যুদ্ধে জার্মানদের একমাত্র নিজস্ব নকশা A7V যার উচ্চতা ছিল এক-তলা বাড়ির সমান!
ইন্ডাস্ট্রিয়াল সারঃ যুদ্ধ শুরুর আগ মূহুর্তে জার্মান কেমিস্ট ফ্রিটস হাবার এবং কার্ল বস পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত নাইট্রোজেনকে প্রচুর চাপ এবং তাপমাত্রায় বায়োলজিক্যাল্লি এমোনিয়াতে রুপান্তরের পদ্ধতি বের করেন। যুদ্ধের সময় এভাবে জার্মানরা কৃত্তিম নাইট্রেট তৈরিত করতে করতে পারত যা থেকে তারা টিএনটির মত বিস্ফোরক তৈরি করত। শুধুমাত্র এ কারনেই জার্মানরা বছরের পরে বছর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পেরেছিল। যদিও যুদ্ধের সময় এটি মরণাস্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
বর্তমানে কিন্ত পৃথিবীর তিন ভাগের একভাগ জনসংখ্যা এই কৃত্তিম সারের জন্যে বেঁচে থাকতে পারছে। কৃষি ক্ষেত্রে কৃত্তিম সারের ব্যবহার নিয়ে কিছু বলা লাগবে আশা করি। এর উপকারীতা এবং ব্যবহারের পরিমাণ আশা করি সবাই জানে।
ফ্লেম্থ্রোয়ারঃ প্রাচীন চীনে পদাতিক বাহিনী বিভিন্ন ধরনের অগ্নি-নিক্ষেপক বা ফ্লেমথ্রোয়ার ডিভাইস করত বলে জনশ্রুতি আছে। এ দিকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে বলে দাবি করা হয়। তবে হাতে বহনযোগ্য ফ্লেমথ্রোয়ারের ব্যবহার প্রথম রেকর্ড করা হয় ১৯১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। এ দিন জার্মানরা প্রথম এই অস্ত্র ব্যবহার করে ভার্দুনের কাছে, মালানকোর্টে। পিঠে নাইট্রোজেনের ট্যাংক বহনকারীর হাতে চিকন নজেলের মাধ্যমে জ্বালানী নির্দিষ্ট দিকে স্প্রে করা হয়। পুরো যুদ্ধে জার্মানরা প্রায় ৩,০০০ এ ধরনের সৈনিক নিযুক্ত করে; যারা ৬৫০ টি অগ্নি-নিক্ষেপক আক্রমণ চালায়।
পয়জন গ্যাসঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উভয় পক্ষ এই মারাত্মক পয়জন গ্যাসের ব্যবহার করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রথম গ্যাস আক্রমণ ছিল জার্মান কর্তৃক। ১৯১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি বলিমভ যুদ্ধে রাশিয়ার উপর প্রথম রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার করে। তবে সাফল্যজনকভাবে প্রথমে ১৯১৫ সালের ২২ এপ্রিলে বেলজিয়ামের ওয়াইপ্রেস এলাকায় ফ্রান্সের সৈনিকদের উপর জার্মানরা কামানের গোলা হিসেবে ক্লোরিন গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার ব্যবহার করে। এর পরে অন্যান্য দেশও বিষাক্ত গ্যাস অস্ত্র তৈরীতে প্রতিযোগিতায় নামে।
উভয় পক্ষই পয়জন গ্যাসের ব্যবহার করে। তবে ঐ সময় ব্যবহৃত এ রাসায়নিক ক্লোরিন গ্যাস চখে ও শ্বাস-প্রশ্বাসে আগ্রমন করত যার ফলে তেমন লোকজন মারা যেত না। অল্প চিকিৎসার পরেই তারা আবার যুদ্ধে ফিরতে পারত। তবে এই অস্ত্র সাময়িকভাবে একটা বড় সংখ্যা সৈন্যদের সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখত।
ট্রেসার বুলেটঃ যুদ্ধের সময় অনেক সময় নানা অসুবিধায় পরতে হত। তেমনি একটি সমস্যা ছিল রাতের বেলা যুদ্ধ করা। কেউ কাউকে দেখতে পারত না কিভাবে গুলি করবে ? এই রাত্রীকালীন যুদ্ধ ব্রিটিশদের ট্রেসার বুলেট আবিষ্কারের পরে সহজ হয়ে যায়। তবে। ঐ ট্রেসার বুলেটগুলো অল্প পরিমানে প্রজ্জলনযোগ্য ফসফোরেসেন্ট বহন করত। ১৯১৫ সালে ব্যবহৃত প্রথম ট্রেসার বুলেটের দৃষ্টি সীমা ১০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এর পরে আরো উন্নত .৩০৩ এসপিজি নামে দ্বিতীয় ট্রেসার ১৯১৬ সালে ছাড়া হয়।
যুদ্ধ বিমানঃ লম্বা উড়োজাহাজে মেশিনগান যুক্ত করার আগ পর্যন্ত বিমান ব্যবহৃত হত প্রাথমিক নিরীক্ষার কাজে। যখন এন্টনি ফোকার বিমানের প্রোপেলারের ঘূর্ণনের সাথে মেশিনগানের গুলি ছোড়ার প্রযুক্তি সমন্বয় করেন তখনই বিমান সত্যিকারের অস্ত্রে পরিনত হয়েছিল।
প্রথম দিকে বিমানের নকশা ছিল অনেকটা আজকালকার খেলনার মত, দূর্বল, ঘুড়ির মত হালকা কাঠ, ফেব্রিক ও তারের তৈরী। ১৯১৪ সালে বিমানের গতি ছিল সর্বোচ্চ ১০০ মাইল প্রতিঘন্টা। এর ইঞ্জিন ছিল মাত্র ৮০-১২০ হর্সপাওয়ারের। চার বছর পর গতি বেড়ে হয়েছিল প্রায় দ্বিগুণ। সে তুলনায় পাইলটের নিরাপত্তা ছিল খুবই অল্প। বেশিরভাগ পাইলট তাদের সাথে বহনকারী প্যারাস্যুটে মোটেও ভরসা করতে পারত না । পর্যায়ক্রমে একাধিক ইঞ্জিন বিশিষ্ট বোমারু বিমান তৈরী হয়; এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ছিল জার্মানির তৈরী। এর পাখা ছিল ১৩৮ ফুট ছড়ানো আর ইঞ্জিন ছিল চারটি, আকৃতির কারণে একে “জায়ান্ট” বলে ডাকা হত। এর পরিসীমা ছিল ৫০০ মাইল আর এতে ৪,৪০০ পাউন্ড ওজনের বোমা বহন করা যেতো।
ডেপথ চার্জঃ যারা নৌ বাহিনী নিয়ে অল্প বিস্তর ধারনা রাখেন তারা অবশ্যই ডেপথ চার্জ শব্দের সাথে পরিচিত। বর্তমানে ডেপথ চার্জ ছাড়া নৌবাহিনী কল্পনা করা যায় না। জার্মান ইউ বোট (ডুবো জাহাজ) মিত্র পক্ষে লাখ লাখ টন কার্গো ডুবিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে হাজার হাজার সিভিলিয়ান, সৈনিক ডুবিয়ে মেরেছে। এর সমাধান হিসাবে আসে ডেপথ চার্জ। একধরনের বোমা যা পানির নীচে গিয়ে ডুবোজাহাজকে আঘাত করত। ডেপথ চার্জ এমনভাবে বানানো হত যাতে নির্দিষ্ট গভিরতায় গিয়ে আঘাত করত। এই আইডিয়াটি ১৯১৩ সালে বের হয়। এর পরে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি কর্তৃক টর্পেডো ও মাইন স্কুলে সর্ব প্রথম ১৯১৬ সালের জানুয়ারিতে ডি টাইপ ডেপথ চার্জ বানানো হয়। আর ডেপথ চার্জের সাহায্যে ২২ মার্চ ১৯১৬ সালে জার্মান ইউবোট ইউ ৬৮ নামে ডুবোজাহাজটিকে ডুবিয়ে দিয়ে ডেপথ চার্জে যুগ শুরু হয়।
বিমানবাহী রনতরী বা জাহাজঃ ১৯১২ সালের মে মাসে ওয়েমাউথ বে থেকে ‘এইএমএস হাইবারনিয়া’ নামের জাহাজের ডেকে তৈরী র্যাম্প থেকে প্রথম কোন বিমান কোন চলন্ত জাহাজ থেকে উড়ে যায় । ছোট S.27 পন্টুন বাইপ্লেনটির পাইলট ছিলেন কমান্ডার চার্লস রুমনে স্যামসন নামের একজন পাইলট। হাইবারনিয়া সত্যিকার অর্থে বিমানবাহী জাহাজ ছিল না। কারন এর ডেকে বিমান সরাসরি অবতরণ করতে পারত না। বিমান আগে পানিতে অবতরণ করতো এবং পরে উড্ডয়নের জন্য জাহাজে তোলা হত। ফলে উঠা নামার জন্যে প্রচুর সময় ব্যয় হত।
আসল বিমানবাহী জাহাজ ছিল ‘এইএমএস ফিউরিয়াস’, যা তৈরী হয়েছিল ৭৮৬ ফুট লম্বা রণতরী হিসেবে যাতে দুটো বিশালাকার ১৮ ইঞ্চি বন্দুক ছিল। ব্রিটিশ নৌপ্রকৌশলীরা যখন বুঝতে পারলো এই বিশালাকার বন্দুকের ঝাঁকুনিতে জাহাজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তখন তারা জাহাজটির বিকল্প ব্যবহারের কথা চিন্তা করলো। তারা বিমানের উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য লম্বা পাটাতন তৈরী করলো। উড্ডয়ন ও অবতরণে জন্য বেশি জায়গার ব্যবস্থা করতে বিমানগুলো রানওয়ের নিচে হ্যাঙ্গারে রাখা হয়েছিল এখনকার আধুনিক বিমানবাহী জাহাজের মত। স্কোয়াড্রন কমান্ডার এডোয়ার্ড ডানিং ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি চলন্ত কোন জাহাজে বিমান অবতরণ করান। তিনি ১৯১৭ সালের ২ আগষ্ট একটি সোপউইথ পাপ বিমান ফিউরিয়াসে অবতরণ করান।
শেষ কথাঃ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (WWI বা WW1), এছাড়াও বিশ্বযুদ্ধ-১, বা গ্রেট ওয়ার হিসাবে পরিচিত এই যুদ্ধ যা ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই ইউরোপে শুরু হয় এবং ১১ নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ৬০ মিলিয়ন ইউরোপীয়সহ আরো ৭০ মিলিয়ন সামরিক বাহিনীর সদস্য ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম এই যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় । এটি এ যাবত বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাতময় একটি যুদ্ধ এবং এর ফলে পরবর্তী সময়ে এর সাথে যুক্ত দেশগুলোর রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন হয়। অনেক দেশে এটা বিপ্লবেরও সূচনা করে। বিল্পবের ক্ষেত্রে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করে। আমরা বেশ কিছু ভাল ও খারাপ আবিষ্কারের সাথে পরিচিত হই। সব মিলিয়ে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ বিশ্ববাসীর সামনে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও অর্থনীতিক দৈন্যতা তুলে ধরে।
সূত্র: ইন্টারনেট
No comments